দীর্ঘদিন ধরেই দূষণের অন্যতম নগরী রাজধানী ঢাকা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চরম অসন্তোষ নগরবাসীর। মশার উপদ্রব নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা আর যানজটে নাকাল নগরবাসী। অগ্নিঝুঁকি নিয়ে তাদের নিত্য বসবাস। রাস্তাঘাটের খোঁড়াখুঁড়ি আর বেহালে চলাফেরাই অনেকটা দায়। অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরে নাগরিক সেবা নিয়ে অসন্তোষ অনেক। এ অবস্থায় আগামী শনিবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত চার মেয়র প্রার্থী তাঁদের ইশতেহারে হাজির হয়েছেন শত প্রতিশ্রুতির ডালা নিয়ে।
একাধিক ভোটার বলছেন—শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না।
আমরা এর পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। আমরা এমন মেয়র চাই, যাঁরা একটি অত্যাধুনিক ঢাকা গড়ে তুলবেন। বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১, অর্থাৎ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে চলছে।
ফলে যাঁরাই মেয়র হবেন, তাঁরা যেন এমন একটি নগরী গড়ে তোলেন, যা হবে উন্নত বিশ্বের অন্যান্য রাজধানীর সমতুল্য।
জানা যায়, আগে যাঁরা ঢাকার দুই সিটির মেয়র হয়েছেন, তাঁরাও ঢাকাকে এগিয়ে নিতে অনেক কাজ করেছেন। তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে এবারের নির্বাচনে যোগ্য নগরপিতা খুঁজে পেতে প্রার্থীদের ইশতেহারকে অনেকটাই প্রাধান্য দিচ্ছেন ভোটাররা।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নিমতলী ট্র্যাজেডি, চুড়িহাট্টার ঘটনা এখনো হৃদয়ে মোচড় দেয় নগরবাসীর। এ ছাড়া প্রায়ই কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগার ঘটনা শোনা যায়। উত্তরেও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত মানুষ। কিন্তু মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে শুধু দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ফজলে নূর তাপস তাঁর ইশতেহারে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি জোরালোভাবে এনেছেন। তবে ইশরাকও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন।
কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে চার মেয়র প্রার্থীর ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নাগরিক সমস্যা সমাধানের প্রায় সব ধরনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সব মেয়র প্রার্থীর ইশতেহারে। দক্ষিণের নৌকার প্রার্থী তাপসের ইশতেহারে রয়েছে পাঁচ রূপরেখা। তিনি ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দক্ষিণের ধানের শীষের প্রার্থী ইশরাক হোসেন বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর বাবা সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার অসমাপ্ত কাজও শেষ করবেন বলে জানিয়েছেন।
গণপরিবহনব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় আধুনিকীকরণসহ নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নজরে এসেছেন ঢাকা উত্তরের নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। আর উত্তরের ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল নগর প্রশাসন করে নাগরিক সেবা ওয়ার্ড পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
জানা যায়, আধুনিক শহরে একজন নাগরিকের ২৪ ঘণ্টাই সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ জন্য সাধারণত হটলাইন খোলা রাখা হয়। কিন্তু ঢাকার দুই নগর ভবনে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ব্যাপারে দুই সিটির আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা রূপরেখা দিলেও বিএনপির দুই প্রার্থীর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি মেলেনি। তবে নাগরিক সেবা বাড়ানো, মশা নিধন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে সব প্রার্থীই প্রায় একই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূল কাজের পাশাপাশি বাইরের অনেক বিষয় উঠে এসেছে বড় দলের প্রার্থীদের ইশতেহারে। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয় বাস্তবসম্মত নয়। তবে প্রার্থীদের ইশতেহারে শহরের পরিচ্ছন্নতা এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো রয়েছে। এ ছাড়া স্মার্ট ও আধুনিকতা এবং নিরাপত্তার বিষয় এসেছে প্রার্থীদের ইশতেহারে।’
সবার শেষে গতকাল বুধবার ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ফজলে নূর তাপস। তাঁর ইশতেহারকে অনেকটাই ‘স্মার্ট ইশতেহার’ বলে মত দিয়েছেন অনেকে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা, এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা করা, বছরের ৩৬৫ দিন সব সময় নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য অফিস খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া গৃহকর না বাড়ানো, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা কার্যকর করতে প্রয়োজনে নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস গঠন ও ফায়ার হাইড্র্যান্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পাড়া-মহল্লায় অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি প্রবেশের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর আলোকে উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তাপস।
গত মঙ্গলবার ১৩ দফায় ১৪৪টি প্রতিশ্রুতিসংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ইশরাক হোসেন। তিনি তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, বিশ্বমানের বাসযোগ্য অত্যাধুনিক ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নারীদের পৃথক ও নিরাপদ বাস সার্ভিস চালু, যানজট নিরসনে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল নির্মাণ, দ্রুতগামী ইলেকট্রিক্যাল বাস সার্ভিস ও স্মার্ট বাস স্টেশন নির্মাণ, যোগাযোগব্যবস্থায় ৫০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ, কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে নারীদের মাতৃত্বকালীন এবং পাঁচ বছর পর্যন্ত সব শিশুর বিনা খরচে চিকিৎসা নিশ্চিতসহ নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাঁর ইশতেহারে।
দক্ষিণের প্রধান দুই প্রার্থীর ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপস পঞ্চায়েতব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, সব সময় নাগরিক সেবা প্রদানসহ নতুন বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা ইশরাকের ইশতেহারে অনুপস্থিত। তবে ইশরাক নারীবান্ধব ঢাকা গড়ে তোলা, যানজট নিরসনে নতুন উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা তাপসের ইশতেহারে নেই। তবে ইশরাক টানেল নির্মাণ, স্মার্ট বাস স্টেশনের যে কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়ন সিটি করপোরেশনের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
সবার আগে গত ২৬ জানুয়ারি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন উত্তরের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা—এই তিন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ৩৮ প্রতিশ্রুতিসংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করেছেন তিনি। এর মধ্যে ছয়টি সম্পূর্ণ নতুন। তাঁর ইশতেহারে সুস্থ ঢাকা গড়তে রাজধানীর মিরপুরে বৃক্ষ ও পোষা প্রাণী ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, করপোরেশনের প্রতিটি অফিসে মাতৃদুগ্ধকক্ষ স্থাপন এবং বায়ুদূষণ কমানোর বিষয়টি নতুনভাবে এসেছে। গণপরিবহনে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা প্রবর্তন, ইলেকট্রিক বাস নামানো এবং সিটি করপোরেশনের সব সেবা কেন্দ্রীয় কমান্ড সিস্টেমে নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলোও নতুন। আধুনিক ঢাকা গড়তে ‘সবার ঢাকা’ নামের একটি অ্যাপ তৈরি করে নাগরিকদের অভিযোগ জানা, সেবাক্ষেত্রে অটোমেশন প্রবর্তন, স্মার্ট নেইবারহুড হিসেবে কয়েকটি এলাকা গড়ে তোলা এবং জনতার মুখোমুখি অনুষ্ঠান আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আতিক।
গত ২৭ জানুয়ারি ১৯ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন তাবিথ আউয়াল। নির্বাচনে বিজয়ী হলে নগর সরকার গঠন করার কথা জানিয়েছেন বিএনপির এই প্রার্থী। ইশতেহারে দূষণমুক্ত, নারী-শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব ঢাকা গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য, পাবলিক টয়লেট, মশক নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহনব্যবস্থা আধুনিক করা, নারীবান্ধব শহর গড়া, নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু, আধুনিক ডে কেয়ার, পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের বিনা খরচে চিকিৎসা দেওয়া, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ, বিনোদনের ব্যবস্থা করা, বাসা ভাড়া নির্ধারণ করাসহ নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাঁর ইশতেহারে। ঢাকাকে ইন্টেলিজেন্ট শহর বানানোর পরিকল্পনার কথাও বলেছেন তিনি।
ঢাকা উত্তরের নৌকার মেয়র প্রার্থীর ইশতেহারে গণপরিবহনব্যবস্থা, নিয়মিত জনতার মুখোমুখি হওয়াসহ বেশ কয়েকটি নতুন বিষয় এসেছে। কিন্তু নতুন প্রতিশ্রুতিগুলো আসলেই সিটি করপোরেশনের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব কি না সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথের ইশতেহারে নগর সরকারের বিষয় এসেছে, যা আতিকের ইশতেহারে নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে প্রধান চার মেয়র প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি প্রায় একই রকম। তবে তাপস ও ইশরাক নতুন কিছু কথা বলেছেন। তবে আমরা চাই, যিনিই মেয়র হবেন তিনি যেন তাঁর প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করেন।’