অন্য আটদশটি মেয়ের মত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের ও মানুষের সেবা করার স্বপ্ন ছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী শিশুটির । স্বপ্ন ছিল দরিদ্র মা-বাবার সংসারের হাল ধরার। যে বয়সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা কিন্তু আজ সেই বয়সে শিশুটি মা হতে চলেছে চার সন্তানের জনক এক নরপিশাচের ধর্ষণের শিকার হয়ে। বন্ধ হয়ে গেছে তার লেখাপড়া। স্কুলে যাওয়াতো দুরের কথা আজ ঘর হতে বের হতে পারছে না লোকলজ্জার ভয়ে। ঘরের কোনে বসে আজ তাকে বহন করতে হচ্ছে ঘৃণাভরা পৃথিবীর অনাকাঙ্খিত ও অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে। মেয়েটি এখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
মেয়েটি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। নেই তাদের ভাল একটা থাকার ঘর। আছে শুধু নয়টিনের একটি ছাপড়া টিনের ঘর। রান্না করার ঘরও নেই তাদের। বাবা যখন যে কাজ পায় ওই কাজই করে দিনমজুর হিসেবে। মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। কিন্তু এখন অন্যের বাড়িতে কাজেও যেতে পারেন না মেয়েকে একা বাড়িতে রেখে। কখন কি যে হয়। এমনিতে মেয়েটি শিশু। অপরদিকে অন্তঃসত্ত্বা। ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। মেয়েকে ভালো কিছু পথ্য খাওয়াবে তাও পারছে না। ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করার টাকাও নেই।
চার সদস্যের সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে দরিদ্র পিতার। আবার মামলার টাকাও জোগাড় করতে হচ্ছে। অসহায় ও নির্যাতিত পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে এগিয়ে আসেনি কেউ। এগিয়ে আসেনি কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা। তবে আসছে ধামরাই প্রেসক্লাবের কয়েক সাংবাদিক। তারা মেয়ের চিকিৎসার জন্য তার মা-বাবার হাতে ৪ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন বৃহস্পতিবার। মেয়েটিকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। মেয়েটির বাড়ি থেকে ঢাকার দুরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে নিয়ে কিভাবে যাবে ঢাকায়- এ নিয়েও পড়েছে মহাবিপাকে।
সরেজমিনে গেলে মেয়েটি জানায়, আমার কি রকম যে লাগে তা কইয়ে বুঝাইতে পারুম না। প্যাটে ও বুকে হঠাৎ করে খুব যন্ত্রণা করে। মেয়েটির মা জানান, মাঝেমধ্যে মেয়েটি পা কুকড়ে মুকড়ে যায়। পেটে ও বুকে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনা। কেউ সহযোগিতাও করে নাই। মেয়েটির বাবা জানান, মেয়েকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য যাইতে কইছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (কাওয়ালীপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক রাসেল মোল্লা)। কিন্তু এই্ অবস্থায় কিভাবে নিয়ে যামু। ট্যাহা পয়সাও নাই। এরপরও তাদের দাবি ধর্ষকের শাস্তি হউক।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সামিউল হক বলেন, মেয়েটিকে আইনগত সহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন।
মেয়েটি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। প্রতিদিনের ন্যায় তার বাবা দিনমজুর ও মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। প্রতিদিনের ন্যায় তারা মেয়েকে বাড়িতে রেখে কর্মস্থলে চলে যান। শিশুটি পাশের মোকছেদ আলীর বাড়িতে প্রায়ই টেলিভিশন দেখতে যায়। এ সুযোগে মোকছেদ তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করে তার স্ত্রীর সহযোগিতায়। ধর্ষণের কথাটি কাউকে বললে জবাই করে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেন তারা। মেয়েটির ভয়ে কাউকে বলেনি। তবে তার মাসিক ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি তার মাকে জানায়। সন্দেহ হলে তারা একটি ক্লিনিকে পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে কয়েকজনের মাধ্যমে শিশুটির পরিবারের সঙ্গে আপসের চেষ্টা চালান চার সন্তানের জনক মোকছেদ আলী। এর মধ্যে একটি চক্র মেয়েটির বাবাকে দুই দফা আটক করে রাখে। সর্বশেষ তারা উপজেলার আমতা ইউনিয়নের নান্দেশ্বরী গ্রামের বাসচালক চানমিয়ার বাড়িতে মেয়েটির বাবাকে ডেকে নেওয়ার পর আটকে রাখেন। সেখানে তাঁর কাছে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন মাতব্বর চক্রের সদস্য চৌহাট ইউনিয়নের মেম্বার ফারুক হোসেন, বালিয়াটি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আল আমীন, ধর্ষকের ভাই দরবার আলী, আবু বক্কর সিদ্দিকসহ কয়েক সদস্য। তারা ধর্ষিতার পিতাকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে জোরপূর্বক আপসনামায় স্বাক্ষর করান। ওই সময় ৬০ হাজার টাকা ধর্ষকের ভাই দরবার আলী মাতব্বর চানমিয়ার হাতে তুলে দেন। সে টাকা আজও পায়নি ধর্ষিতার পরিবার। কিন্তু টাকার লোভে ধর্ষকের সঙ্গে আপস করেননি ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবা-মা। তারা ধর্ষকের শাস্তি চান।
সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘটনাটি জানার পর ধামরাই থানা পুলিশের সহযোগিতায় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবা থানায় মামলা করেন। মামলায় প্রথমে আটক করা হয় আল আমীনকে। পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এরপর ধর্ষক মোকছেদ আলী ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।
এ নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠে গত বছরের ২৬ অক্টোবর ‘ধামরাইয়ে শিশু ধর্ষণে জরিমানার টাকা ভাগ করে নিল মাতব্বররা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।