অপরাধবিশেষ প্রতিবেদন

চাটখিলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তার তালিকায় ২৬০ জনের মধ্যে অর্ধশতাধিক নাম নিয়ে বিতর্ক

চাটখিলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তার তালিকায় ২৬০ জনের মধ্যে অর্ধশতাধিক নাম নিয়ে বিতর্ক

নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নে করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তার দুই হাজার পাঁচ শত টাকার তালিকায় ২৬০ জনের মধ্যে অর্ধশতাধিক নাম নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এই অর্ধশতাধিক বিতর্কিত নামের তালিকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা ও তাদের স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অন্যান্য ভাতাভোগী ও প্রবাসীসহ অনেক উচ্চবিত্তে ও উচ্চ মধ্যবিত্তের নাম রয়েছে। তবে এদের মধ্যে মাত্র ১২ জনের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অভিযোগ যাচাই করতে উদ্যোগী হয়েছে উপজেলা পরিষদ। এজন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তরুণকে শোকজ পত্র দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ দিদারুল আলম।

এর আগে, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ২৬০ জনের নামের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়ার পর স্থানীয় এলাকাবাসীকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি দলের স্থানীয় এক নেতা বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নামের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়ায় প্রকৃত বিষয়টি উঠে এসেছে। তালিকায় প্রকৃতদের বাদ দিয়ে সরকারি চাকরিজীবী, ইউপি সদস্য, ব্যবসায়ী, প্রবাসী এবং দলীয় নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের নাম আসায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এতে দলের যে অর্জন তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

পাঁচগাঁও ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, প্রকৃত প্রণোদনা যারা পাওয়ার যোগ্য তাদের বাদ দিয়ে সরকারি চাকরিজীবী, ইউপি সদস্য ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, প্রবাসী ও বিত্তশালীদের নাম প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তা তালিকায় চেয়ারম্যান তার অনুগত লোকদের নাম প্রদান করেছেন।

শেফায়েত নামে আরেক ব্যক্তি জানান, ‘এটা কোনোভাবে ঠিক হয়নি। বিত্তশালী, ব্যাংকার, শিক্ষক-যারা ত্রাণ দেওয়ার যোগ্য, তারা পেয়েছেন ত্রাণের টাকা। এতে প্রকৃত গরিব, দুস্থরা বঞ্চিত হয়েছেন। যারা কর্মহীন আছেন তারা এ সহায়তা পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চান যারা প্রকৃতভাবে এ প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য, তারা যেন এ অর্থ পান। তারা এ তালিকা বাতিল করে, পুনরায় যাচাই-বাচাই করে প্রকৃত উপকারভোগীদের নাম যেন অন্তর্ভুক্ত হয় সে দাবি জানান।’

তালিকার ২৫১ নম্বরে থাকা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, আমার নাম বিশেষ সহায়তা তালিকায় দিয়ে তারা আমাকে বেইজ্জত করেছেন। তারা এটা ঠিক করেননি। আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে চেয়ারম্যানের এ ধরনের কাজের প্রতিবাদ জানিয়েছি। এরপর মুঠোফোনে এর কৈফিয়ত চাইলে তিনি নাম পরিবর্তন করে দেবেন বলে জানান।

তালিকার ২২৫ নম্বরে থাকা ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহজাহান এবং ২২৩ নম্বরে তার ছেলে রেজাউল করিমের নাম থাকায় বিব্রত তারা। এ প্রসঙ্গে মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমরা কেউ জানি না। আমি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তরুণকে বললে তিনি বলেন, নামগুলো ক্যান্সেল (বাতিল) করানো হয়েছে।’

তালিকার ২৫৩ নম্বরে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছ থেকে এছাড়া আরও দুইবার নাম নিয়েছে। আমি বলেছি, আমার দরকার নেই। এরপর আমার নাম ও মোবাইল নম্বর নেয় এবং পরে আইডি নেয়। ৭/৮ দিন পর বললো আপনি দুই হাজার টাকা পেয়েছেন, আড়াই হাজার বলেনি। আল্লাহ আমাকে এ টাকা না খাওয়াক। আমি পাওয়ার উপযুক্ত না। যে পাওয়ার যোগ্য, তাকে দেওয়া হোক।

তালিকার ২৫৮ নম্বরে থাকা হোসেনপুর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বোরহান বলেন, ‘আমার কাছ থেকে এনআইডি ও মোবাইল নম্বর কেউ চায়নি। আমি যখন শুনতে পেয়েছি, তখন আমি চেয়ারম্যানকে কীভাবে আমার নাম আসলো তা জানতে চাই। আমার নাম উইথড্র করার কথা তাকে ফোনে জানাই। কে বা কারা আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এটা করেছে। বিশ্বাস করেন আপন গড (খোদার শপথ), আমি কিছু জানি না।’

২৩৫ নম্বরে রয়েছে আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের নাম। তিনি বলেন,‘আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমি কিছু জানি না। আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি আবু তোরাব জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। মুয়াজ্জিন এর ভাতা আছে বলে, ভোটার আইডি নম্বর ও মোবাইল নম্বর নেয়। আমি সরকারি চাকরি করি, আমার এ টাকার দরকার নেই।’

২৪৯ নম্বরে নাম থাকা কামাল হোসেন চাটখিল সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মচারী এবং পাঁচগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ এর সভাপতি। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘এ বিশেষ সহায়তা তালিকায় আমার নামটা প্রত্যাহার করে অন্য কাউকে দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে আমি খুশি হবো।’

তালিকার ১৫৫ নম্বরে থাকা চা দোকানদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তালিকায় তার মোবাইল নম্বর ভুল আছে। এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে ফোন করলে তিনি বলেন, এটা সংশোধন করার সুযোগ থাকলে করে দেবেন।’

তালিকার ১৫৪ নম্বরের থাকা মুয়াজ্জিন মো. সোহেল বলেন, ‘তালিকায় আমার নামের পাশে মোবাইল নম্বর ভুল দেওয়া রয়েছে।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। আপনারা যাচাই করে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তা প্রকৃতরা যাতে বঞ্চিত না হয়। তবে, বিষয়টি দলের জন্য বিব্রতকর।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ও বিশেষ সহায়তার ট্যাগ অফিসার ফারুক হোসেন বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি আমাকে ও উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ড. সাইদুর রহমানকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি আইসোলেশনে রয়েছেন। এ কারণে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেকটি লোকের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে, নিরপেক্ষ প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট দ্রুত সময়ের মধ্যে জমা দেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ইতোমধ্যে ১২ জনের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অভিযোগ আসায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে শোকজ পত্র দেওয়া হয়েছে। তাকে ৩ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও ত্রাণ পাওয়া ব্যক্তিদের নাম এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে অন্যের কাছে সহায়তা চাইতে পারছেন না এমন মধ্যবিত্ত কারও নাম আসতে পারে। এরপরও তদন্ত প্রতিবেদনে যদি আরও কারও ব্যাপারে আপত্তি আসে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাঁচগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তরুণ বলেন, ১২ জনের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে উত্তর প্রস্তুত করছি। কাল জমা দেওয়া হবে। এছাড়া আরও আপত্তি যদি আসে, সুযোগ থাকলে সেগুলোও সংশোধন করে দেওয়া হবে।তথ্য সুত্রঃবাংলা ট্রিবিউন

Comment here