আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে মুসলিম লীগের কট্টর অংশ এবং সমাজের ধনীক শ্রেণিদের একটা বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের অগাধ টাকা এবং প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিপরীতে শুধু সৎ সাহস এবং আপামর জনতার শক্তির ওপর ভরসা করে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জোড়দার করতে থাকেন তরুণ শেখ মুজিব।
মানুষের প্রতি আত্ম নিবেদন এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই সব রকমের স্বার্থ পরিত্যাগ করে এরকম ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন তিনি। এর আগে, তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম লীগকে জমিদার-নবাব-খান বাহাদুরদের কব্জা মুক্ত করে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এটি বাস্তবায়নে একটি তরুণ ও গতিশীল প্রজন্ম গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। একই সঙ্গে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার দাবি তোলেন।
১৯৪৯ সালের ২৯ জানুয়ারি খুলনার এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্কে ঢাকা, ফরিদপুর ও কুমিল্লার প্রায় ৩৫০ জন কৃষকের সমাবেশে যোগ দেন। তিনি তাদের নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাঙলোয় যান এবং ধানকাটার মজুরি বাবদ পাওয়া ধান নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার পারমিট দাবি করেন। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড]

তিনি জেলা-মহকুমায় ঘুরে ঘুরে কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রকৃত অর্থেই ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক শহর থেকে আরেক শহরে। তিনি কৃষকের পাশে কীভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা লিখে গেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও আমরা পাই এর বিশদ বিবরণ। ফরিদপুর, ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলার ধান কৃষক-দিনমজুররা ধান কাটার জন্য খুলনা, বরিশাল, সিলেট প্রভৃতি জেলায় যেতেন। তারা ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য ধানের অংশ পেতেন এবং সেটা নৌকায় নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এদের বলা হত দাওয়াল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দাওয়ালদের ধানের নৌকা আটকাতে শুরু করল। বলা হতো, ধান জমা না দিলে নৌকা ও ধান বাজেয়াপ্ত করা হবে। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের কাছ থেকে পাকা রসিদ ছাড়াই ধান জমা হচ্ছিল। কিন্তু নিজ এলাকায় ফিরে তার বিনিময়ে কৃষকরা ধান পাচ্ছিল না। এভাবে দাওয়ালরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।

১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের কুমিরায় অনুষ্ঠিত জনসভায় সরকারের পাটনীতির সমালোচনা করেন। চট্টগ্রাম থেকে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ যান সিলেট। সেখানে কোর্ট প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভূমির উচ্চ সিলিং করে উদ্বৃত্ত জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের দাবি করেন। পরে যান বরিশাল। সেখানে বলেন, কৃষক সমাজ তথা পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষ করার জন্য অবিলম্বে পাট জাতীয়করণ করতে হবে এবং দালালদের মারফত না কিনে সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনতে হবে।
তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। নির্বাচনের পরপরই (১১ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নের সম্মেলন সভাপতিত্ব করেন। পহেলা মে তিনি ভাষণ দেন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক সমাবেশে। ১৯৫২ সালে চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সে দেশের কমিউনিস্ট সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১ দফার ২ থেকে ৮ নম্বর দাবি ছিল কৃষি সম্পর্কিত। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়েও ২১ দফা বস্তবায়নের ওপর বারবার জোর দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সদস্য হলে তার হাতে অনেকগুলো দফতর সামলানোর ভার পড়ে। এর মধ্যে ছিল কৃষি শিল্প উন্নয়ন ও পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা। কৃষি নিয়ে যে সব দাবি সামনে এনেছেন, তা বাস্তবায়নের সুযোগ আসে হাতে এবং তিনি বিপুল উৎসাহে অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত্নবান হন
১৯৫৬ সালের ১৮ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। সম্মেলনে তিনি সাত দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। কৃষকদের বড় ধরনের এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করার সম্মান দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এবং সার্টিফিকেট প্রথা ও খাজনার সুদ বন্ধ করার দাবি জানান।
ষাটের দশকে তিনি আওয়ামী লীগের শ্রমিক শাখা গড়ে তোলায় নজর দেন। এর আগে মূলত বামপন্থীরাই শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্ব দিতেন। অর্থনৈতিক দাবির পাশাপাশি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায় ও শোসণ-বঞ্চনার দাবি তিনি তুলে ধরেন এবং তাতে বিপুল সাড়া মেলে। ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে শ্রমিকদের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল এরই প্রত্যক্ষ ফল। এর আগে যত আন্দোলন হয়েছে, কখনোই শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতাকে একসাথে রাজপথে নামতে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিকবান্ধব নীতির কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষ মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের তাদের এই স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একটি অনবদ্য মাইলফলক। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে কৃষি ব্যবস্থা এবং সমাজকাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।