সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে বসে টেলিভিশনের প্রোগাম দেখছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর দূরদর্শন বাংলায় একটি অনুষ্ঠান শুরু হবে সেটি দেখাই উদ্দেশ্য। চ্যানেল পাল্টালেন। রিমোট কন্ট্রোলে ‘জাম্প’ বাটন নেই কিংবা থাকলেও তা ব্যবহার করতে জানেন না বলে এক এক করে চ্যানেল বদলাচ্ছিলেন।
চ্যানেলগুলো ঝিরঝিরে বলে থিতু হতে পারছিলেন না কোথাও। হঠাৎই একটা চ্যানেলে স্ক্রিনটাকে ঝকঝকে মনে হল। ওটায় ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। খানিকটা থামলেন। একজন ব্যাটসম্যান আউট হতেই গ্যালারির দর্শকেরা চিৎকার করে উঠল “আউট, প… আউট”!
প… এর মানে হতে পারে পন্টিং, পাওয়ার, প্যাটেল, পিযুস কিংবা ‘প’ দিয়ে নাম যে কোন ক্রিকেটার। কিন্তু তার মনে ঢুকে গেল ‘পলিথিন’।
তিনি বিড়বিড় করলেন, ‘আউট, পলিথিন আউট”। ফের জোরসে বললেন, “আউট, পলিথিন আউট”।
পলিথিনের কুপ্রভাব সম্পর্কে তিনি ভালই অবগত আছেন। সরাসরি আগুনে তো বটেই, এমনকী রোদের তাপেও পলিথিন গলে গিয়ে বাতাসে মিশে নাসারন্ধ্র দিয়ে ফুসফুসে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে পলিথিনের উপাদান। কর্কট ব্যাধি ঘটাতে ওস্তাদ এসব উপাদান। পলিথিন পচে না বা মাটিতে মেশে না। স্থলে থিতু থেকে কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটায়। ড্রেনেজ সিস্টেমে গণ্ডগোল পাকিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। পুকুর, ডোবা, নদী-নালার তলায় অবস্থান করে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি করে বিপন্ন করে মৎসসম্পদ। পলিথিন তথা প্লাস্টিক বর্জের কুপ্রভাবের সবই জানা তার। তিনি স্থির করলেন পলিথিনের বিরুদ্ধে লড়বেন, গড়বেন জনমত।
কদিন পরেই পাটগ্রাম অনাথবন্ধু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। তিনি স্থির করলেন এখানে সমবেত হওয়া তুর্কিতরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন প্রাণঘাতি পলিথিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা। দুটি প্ল্যাকার্ড তৈরি করলেন তিনি। বড় বড় করে লিখলেন- “আউট, পলিথিন আউট”।
নির্ধারিত দিনে যখন ভোরবেলায় তিনি মাঠে এলেন তখন তার বুকে ওপিঠে ঝুলছে “আউট, পলিথিন আউট”। পলিথিনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার মন্ত্র দিয়ে উজ্জীবিত করছেন সবাইকে। সবাই চেঁচিয়ে উঠছে “আউট, পলিথিন আউট” রবে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সারাদিন ধরে বুকে-পিঠে স্লোগান নিয়ে মাঠে দৌড়ালেন তিনি আর সহস্র কণ্ঠে ধ্বণিত হল, “আউট, পলিথিন আউট”।
এতক্ষণ ধরে যার কথা বলছিলাম তিনি ‘বাবু হরিপদ সূত্রধর’। পাটগ্রাম অনাথবন্ধু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক। আমাদের ‘পদ্মাপাড়ের সক্রেটিস’।
৭২ বছর বয়সেও যিনি সাংষ্কৃতিক কর্মকাণ্ড চর্চার মধ্য দিয়ে বিবিধ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবেশ, জনপদ, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায়।
মানুষটির কথা আগে বহুবার শুনেছি। শুনে শুনেই নত মস্তকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। গত ১৭ জানুয়ারি যখন তার দেখা পেলাম, কথা বল্লাম তখন মনে হল- এমন মানুষের পায়ের কাছে বসে গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেও জীবনের অপচয় হবে না।
হাজার বছর বেঁচে থাকুন স্যার।
সাইজি শাহাদত-এর ফেসবুক থেকে